করোনার ভয়াবহ প্রকোপের কেউ কেউ পশুর হাট নিরুৎসাহিত করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার যে বিশাল বাজার, তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সহজ নয়। এর ধর্মীয় দিক তো আছেই, অর্থনীতির দিকটাও উপেক্ষা করা যায় না। এর সঙ্গে রয়েছে চামড়া শিল্প ও রফতানি বাজারের বিষয়টি।
করোনাকালের দ্বিতীয় (২০২১) কোরবানির পশুর বাজারের কয়েকদিন আগে খবর প্রকাশিত হয়- ১ কোটি ১৯ লাখের মতো গরু-খাসি-দুম্বা-উট কোরবানি হবে। এর সূত্র ধরে একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ফেসবুকে প্রশ্ন রেখেছিলেন- সারা দেশের বাজারে কত পশুর চাহিদা, সেটা কীভাবে নির্ধারিত হয়? সাম্প্রতিক বছরগুলোর কোরবানির পশু কেনাবেচার খবর পত্রিকায় পাঠ ও টেলিভিশনে শুনে তার ধারণা হয়েছে- একটি অদৃশ্য সূত্র বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখে। কোরবানির হাটগুলোতে চাহিদা ও সরবরাহে খুব বেশি হেরফের হয় না। শহর ও গ্রামে হাটে যত পশু আনা হয়, এর প্রায় সবটাই বিক্রি হয়ে যায়। কোনো কোনো বছর বাজারে চাহিদার তুলনায় সামান্য ঘাটতি কিংবা বাড়তির খবর জানা গেলেও সেটা তেমন উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছে না।
এই যে চাহিদা ও সরবরাহে মোটামুটি ভারসাম্য- সেটা কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে দিচ্ছে, তেমনটি শোনা যায় না। ব্যবসায়ীদের নানা সংগঠন রয়েছে। গবাদি পশুপালকরা এখন সংগঠিত হতে শুরু করেছে। বেশ কিছু বড় খামার গড়ে উঠছে, যেখানে মাংস ও দুধ উপাদনের জন্য শত শত গরু পালন করা হয়। পাঁচ-দশটা গরু পালন করছে অনেক পরিবার। আর পারিবারিকভাবে পশুপালন তো সেই যুগ যুগ ধরে চলছে। কিন্তু বাজারের আকার বা সাইজ যখন এক কোটি ছাড়িয়ে যায়, তখন বিষয়টি সিরিয়াস পর্যালোচনার দাবি রাখে। ঢাকার কোন হাটে কত পশু যাবে, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো বড় বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য কীভাবে ঠিক রাখা- জটিল ধাঁধা বটে!
আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোরবানির পশুর হাটের সঙ্গে যুক্ত- চামড়া শিল্পের কাঁচামাল এবং ভারতীয় পশুর ওপর নির্ভরতা বহুলাংশে কমে যাওয়া।
মাত্র একদশক আগেও কেউ কি ভেবেছিল যে ভারত বাংলাদেশে পশু সরবরাহ (চোরাই পথে এবং আধা বৈধ পথে) বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশের মাংসের বাজারে চমর অস্থিরতা দেখা দেবে না? বিজেপির নরেন্দ্র মোদি দিল্লির শাসনক্ষমতায় আসার পর পরই কোরবানির সময় বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসবে না, এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কোরবানির দিন পনেরো আগে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সাংবাদিকদের সঙ্গে এক আলোচনায় বেশ আনন্দচিত্তে ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘নিশ্চিত থাকুন, কোরবানির গরু আসবে।’
এরপর তুমুল করতালি পড়েছিল। স্বস্তিও নেমে এসেছিল। কেউ কেউ বলছিলেন- যাক, গরুর দাম লাখ টাকায় উঠবে না। তখন এমনও ধারণা ছিল, বাংলাদেশে ভারতের গরু না আসলে প্রতিদিনের বাজারে মাংসের দাম প্রতি কেজি দুই হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। গত কয়েক বছরে অবশ্য লাখ লাখ লোক লাখ টাকা দামের গরুর দিকে তাকাতেও উৎসাহ দেখায় না, এমন খবর দেখছি।
বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের ধারণা ছিল, বাংলাদেশে যেহেতু জমি কম, তদুপরি মেহগনি ও ইউক্যালিপটাসসহ অনেক ধরনের বিদেশি জাতের গাছের বিস্তারের কারণে দেশীয় ঘাসের উৎপাদন কম হচ্ছে- এমন অবস্থায় গবাদিপশুর সংখ্যা বাড়ানো কার্যত অসম্ভব। এ অবস্থায় মাংসের ঘাটতি মেটাতে ভারতের ওপর, দুধের ঘাটতি মেটাতে অস্ট্রেলিয়া-নেদারর্যান্ডের ওপর নির্ভরতা থাকবেই।
কিন্তু কত কম সময়ের মধ্যেই চিত্র বদলে গেল, বদ্ধমূল ধারণা পরিণত হলো অবাস্তব বিষয়ে। ধানের উৎপাদন বাড়িয়েও, ফল-শাক-সবজির ফলনে রেকর্ড করেও এবং মিঠাপানির মাছের চাষে বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করার পরও বাংলাদেশ নিজস্ব উৎপাদন থেকেই কোরবানির পশুর বিশাল চাহিদা মেটাতে পারছে। দৈনন্দিন মাংসের বাজারও রয়েছে মোটামুটি স্থিতিশীল। দেশি গরুর দুধের জোগানও বাড়ছে। মিল্ক ভিটা, আড়ংসহ কয়েকটি কোম্পানি এখন তরল দুধের বাজারে সক্রিয়। এর পেছনে কোনো ম্যাজিক কাজ করছে? গবেষকরা মাথা ঘামাতেই পারেন।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পরই যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংক থেকে একদল বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিত বলতে শুরু করেন- খনিজ সম্পদ নেই। খাদ্যে পরনির্ভর। লেখাপড়া বেশিরভাগ লোকের নেই, যাদের আছে শিক্ষার মান বড়ই খারাপ। নারীদের প্রায় সবাই পর্দানশীল। তদুপরি আছে ঝড়-বন্যা-খরার প্রকোপ। এ দেশটি বাস্কেট কেস বা পরনির্ভর হয়েই থাকবে। বিদেশিরা ঋণ বা অনুদান দিলে বেঁচে থাকবে।
১৯৯৮ সালের প্রবল বন্যার সময় বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়- অন্তত দুই কোটি লোক মারা যাবে না খেয়ে ও চিকিৎসা-সুবিধার অভাবে। এবারে করোনার শুরুতে বলা হলো- লাখ লাখ বিদেশি ফিরে আসবে কাজ হারিয়ে। রফতানি বাণিজ্যে ধস নামবে। প্রবাসে কাজ করছে যারা তারা ডলার-ইউরো-রিয়াল পাঠাবে খুব কম। আল জাজিরা টিভি বলে দিল- অন্তত ২০ লাখ লোক মারা যাবে করোনায়।
বাস্তবে এসব ঘটেনি। বরং ভিন্ন চিত্র দেখি আমরা। করোনার মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেল পদ্মা সেতু। বিশ্বব্যাংক বলেছিল- তাদের ঋণ ছাড়া ৩০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কিন্তু কী করে সম্ভব হলো এটা? এ ধাঁধার জট খুলতে গবেষণা হতেই পারে।
কোরবানির পশুর হাটে এ বছর অবশ্য চাহিদা ও সরবরাহের জোগানে বড় ধরনের অসংগতি দেখা গেছে। অদৃশ্য সূত্র কাজ করেনি। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বলছে, প্রাথমিক অনুমানের তুলনায় অন্তত ৩০ লাখ গরু-খাসি বিক্রি কম হয়েছে। যারা হাটে পশু নিয়ে এসেছেন তারা ছোট-মাঝারি-বড় ব্যবসায়ী। কারো ১০ কোটি টাকা বা তারও বেশি মূলধন খাটছে এ বাজারে। যারা একটা-দুইটা পশু লালন-পালন করে কোরবানিতে দুই-চার হাজার টাকা বাড়তি আয়ের জন্য, তারা কোরবানির আগেই তা বিক্রি করে দিয়েছেন। তারা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
যেসব ব্যবসায়ী বাড়ি বাড়ি বা ছোট-বড় খামার থেকে শত শত গরু সংগ্রহ করেছেন এবং এর একটি অংশ বিক্রি করতে পারেননি, তারা সমস্যায় পড়বেন। নিত্যদিনের বাজারে এ পশুর তেমন চাহিদা নেই। তদুপরি আছে, খাবার ও ওষুধের বিপুল ব্যয়। কীভাবে তা মেটাবেন? যারা কোরবানির পশুর চাহিদার কথা ভেবে ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন, তাদের বাড়তি সমস্যা হবে। এটাও কিন্তু মস্ত ধাঁধা।
পশু কোরবানি ৩০ লাখ কম হলে চামড়া শিল্পে এর প্রভাব পড়ার কথা। আবার চামড়া শিল্পের মালিকরা বলছেন, তাদের মজুদ ভাণ্ডার ভালো। গতবারের চামড়াও সবটা রফতানি করা যায়নি। অর্থাৎ কোরবানির সংখ্যা কম হলেও চামড়া শিল্পে হাহাকার পড়বে না। কিন্তু কাঁচা চামড়া যাদের হাতে জমা আছে, তাদের একটি অংশের সমস্যা হবে।
করোনার ভয়াবহ প্রকোপের কেউ কেউ পশুর হাট নিরুৎসাহিত করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার যে বিশাল বাজার, তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সহজ নয়। এর ধর্মীয় দিক তো আছেই, অর্থনীতির দিকটাও উপেক্ষা করা যায় না। এর সঙ্গে রয়েছে চামড়া শিল্প ও রফতানি বাজারের বিষয়টি।
এ সব বিষয় অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের ভাবনায় থাকবে, এটা আশা করতেই পারি। করোনার প্রকোপ যদি ২০২২ সালের কোরবানি পর্যন্ত চলে? কিংবা এ বিপদ যদি আরও প্রলম্বিত হয়? দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।
মন্তব্য করুন