শ্যাম পীরিতি আমার অন্তরে- এক সময়ের সুপার হিট ফিল্মি গান। গায়ক ছিলেন টেলিসমাদ। গানটিতে অভিনয়ও করেছিলেন তিনিই। শ্যামের পিরিতি নিয়ে বাংলা-ভারতে বহু কাহিনী, মিথ, উপাখ্যান। আম নিয়েও কম নয়। বরং আরো বেশি। মহামারি করোনাকালে এর কিছুটা রিমেক হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে আম উপহার পাঠানোর মধ্য দিয়ে এতে কিঞ্চিত মাত্রা যোগ হয়েছে। ইমরান খানকে এক টন হাড়িভাঙ্গা আম পাঠানো নিয়ে এদিকে-ওদিকে হাটে হাড়িভাঙ্গার চেষ্টাও আছে। এতে হালকা-ভারি, সূক্ষ স্থূল নানান কূটনীতি-রাজনীতি মাখানোর প্রবণতা রয়েছে।
করোনার জেরে বৈশ্বিক রাজনীতির বাঁক বদলের সন্ধিক্ষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জন্যও আম পাঠানোর মধ্যে কূটনীতি আবিষ্কার অবান্তরও নয়। শিশুশিক্ষায় আ দিয়ে আম শেখানো হয়। আঁকানোও হয়। আমজনতার কাছে আম বিষয়ক গবেষণার গরজ নেই। তাদের ধারনা হাজার-হাজার বছর ধরেই এই অঞ্চলে আম ছিল। নইলে আমের কথা কেন পুরাণে আছে? কালিদাসেও আছে। গৌতম বুদ্ধ আমবাগানের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, বৈশালীর আম্রপালি ছুটে এসেছিলেন তাঁর কাছে, আলেকজান্ডারের আমের প্রশংসা, বাদশাহ আকবরের এক লাখ গাছের আমবাগান, বীরবলের আম খাওয়া, পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, মেহেরপুরের আম্রকাবনে বাংলার অস্থায়ী সরকার গঠন- আম নিয়ে এমন কথার শেষ নেই। আমাদের জাতীয় সংগীতে আছে আমের বনে ঘ্রাণে পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। অপু আর দুর্গার কালবোশেখিতে আমগাছতলায় ছুটে যাওয়া, ফরিদা পারভীনের গাওয়া ‘সেখানে আম কুড়াবার ধুম পড়েছে চলো না অন্য কোথাও যাই’সহ বহু গান-কবিতায় তো আমের কথা আছেই।
যার যত টিকা বা ভ্যাকসিনের ঠিকাদারি-খবরদারি, সেই তত শক্তিমান। শক্তির এই জানান দেওয়ার দৌড় এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এ অঞ্চলে চীনের এ সক্ষমতা তুঙ্গে। চীনারা সঠিক সময়ে লকডাউন, মেডিসিন, নার্সিং, সার্ভিসিং এবং ভ্যাকসিন দিয়ে করোনা বিদায় করেছে। ভারত সেখানে হোঁচট খেয়েছে চরম আঘাতে।
ইতিহাস-ঐতিহ্য, অর্থনীতি, বর্ণ, গন্ধ, রস, স্বাদের সঙ্গে আম নিয়ে রাজনীতি নতুন নয়। শেরেবাংলা ফজলুল হকের এক বসায় কয়েক ডজন আম খাওয়া, ফাঁসির আগে কর্নেল তাহেরের নিজ হাতে কেটে আম খাওয়া, নিয়েও কিছু কথা বেশ প্রচারিত। আম নিয়ে উৎসব তো হয়ই। করোনার কারণে এবার নেই। তবে, কূটনীতিতে ভালো অবস্থানে এবার আমের আরো জোগান পড়েছে। হাঁড়িডভাঙ্গা আম ভারত-পাকিস্তানে হয় না। গণমাধ্যমে কেবল ভারত-পাকিস্তানে আম পাঠানোর তথ্য আসায় খবরটি খণ্ডিত হয়ে গেছে। ওমানেও আম গেছে। ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কুয়েতও বাদ পড়ছে না। কিন্তু, যে কারণেই হোক সেই খবর প্রকাশে কৃপণতা লক্ষনীয়। ভারতের কিছু গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব দিয়ে আম নিয়ে স্পেশাল ডিপ্লোমেটিক অ্যাসাইনমেন্ট হয়েছে।
পাকিস্তানের দুই সাবেক সেনাশাসক জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফ এবং নওয়াজ শরিফের আম কূটনীতির কথা এসেছে ওইসব রিপোর্টে। আম কূটনীতির অতীত-বর্তমান তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়েছে, বরিস জনসন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফজলি আম পাঠিয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। চাইলেই সব দেশে উপহার হিসেবে ফল পাঠানো যায় না। অর্থাৎ আম কূটনীতি সবার সঙ্গে করা যায় না। অস্ট্রেলিয়াসহ কিছু দেশে তা সম্ভব হবে না তাদের উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ সঙ্গনিরোধ আইনের কারণে। সেইসব দেশে গাছপালা, ফলমূল ও প্রাণি আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ থাকায় এ ধরনের উপহার পাঠানো সহজ নয়।
পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৭ সালে শ্রীলঙ্কায় শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের কাছে আম পাঠিয়ে লজ্জিত হয়ে ছিলেন। বন্দরনায়েকে সেই আম ফেরত দিয়েছিলেন। তিনি না-কি বলেছিলেন, যে ব্যক্তির হাতে পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর রক্ত লেগে আছে, তাঁর কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করতে পারছি না বলে দুঃখিত। ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ কয়েকটি দেশের পাকিস্তানের আম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর আরো খবর আছে। আর উপহার হিসেবে উপমহাদেশে আমের ব্যবহারও পুরোনো। ভারতবর্ষে মোগল আমল থেকে এই আমের সঙ্গে ক্ষমতা, কূটনীতি ও আনুগত্যের যোগসূত্রের নানা নজির রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেবের বিরোধ।
দাক্ষিণাত্যের শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেব সম্রাট শাহজাহানের দরবারে আম না পাঠানোর কারণে তাঁকে বন্দী করেছিলেন। পরে আওরঙ্গজেব যখন মসনদ দখল করেন, তখন পারস্যের সম্রাট শাহ আব্বাসের সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁকে উপহার হিসেবে আম পাঠিয়েছিলেন। আম কূটনীতির সূচনা ভারতে হলেও চর্চায় তা বেশি পাকিস্তানে। আম উৎপাদন ভারতের তুলনায় কম হলেও আম নিয়ে কূটনীতি পাকিস্তানই বেশি করে আসছে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর চীনের মাও সে তুংকে একবার আম উপহার পাঠানো ছাড়া ভারতের আর কারো আম কূটনীতির তথ্য মিলছে না।
পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে আম পাঠানোর জের প্রকাশ হয়নি। তবে, ১৯৮১ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডিকে আম পাঠিয়ে বাজে অবস্থায় পড়েছিলেন জেনারেল জিয়াউল হক। প্রধানমন্ত্রী আমের সঙ্গে পাঠানো বার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন এটি তাঁর দেশের সেরা আম। ‘রাতাউল’ নামের ওই আমের প্রশংসা করে স্বদেশে বিপত্তির মুখে পড়েন ইন্দিরা গান্ধী। রাতাউল নামের ওই আম পাকিস্তানের নিজস্ব কোনো জাত নয় বলে প্রতিবাদ জানান ভারতের রাতাউল জেলার আমচাষিরা। তাঁরা দাবি করেন, দেশভাগের সময়ে রাতাউল থেকেই আমগাছের কিছু চারা নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানে ওই জাতের চাষ করা হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সেই রাতাউল আমে দু’দেশের বিরোধ আরো বাড়ায়। বলা হয়ে থাকে জেনারেল জিয়াউল হক যে বিমান বিধ্বস্তে নিহত হয়েছিলেন, সেই বিমানে বিস্ফোরণের উৎস ছিল দুটি আমের ঝুড়ি। পাকিস্তান আম কূটনীতিতে ব্যাপক আলোচিত হলেও আমে কূটনৈতিক সাফল্য এসেছে কম। দুই দেশের মধ্যে পেয়ার-প্রীতি মধুর করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সুস্বাদু সিন্ধ্রি ও চৌসা আম পাঠানোর ঘটনাও রয়েছে। এই ফলে শেষতক সুফল আসেনি।
পাকিস্তানের চেয়ে ভারতে আমের ফলন অনেক বেশি। ভারতে বোনলেস বা আঁটিহীন আমও আছে। এটি উৎপাদন হয় ভারতের বিহার রাজ্যের ভাগলপুরে। আলফানসো এবং রত্না আমের সংমিশ্রণে এটির উদ্ভাবন করেছেন ভাগলপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। নাম দিয়েছেন সিন্ধু। আঁটিহীন বলা হলেও একেবারে তা নয়। আমটির ভেতরে বিচির মতো অতিক্ষুদ্র আকারের (৬ মিলিমিটার লম্বা) একটি আঁটির অস্তিত্ব রয়েছে। ফলে একটি আমের ৯৫ শতাংশই খাওয়া যায়। এরপরও ভারত আম কূটনীতিতে বেশি এগুচ্ছে না। তাদের নজর বেশি টিকা কূটনীতিতে।
মহামারি বা মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে রাজনীতি-কূটনীতি ঘৃণিত-অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে এ নিয়ে কেবল চর্চা নয়, রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। তিউনিশিয়ায় করোনা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী উৎখাত হয়ে গেছেন। টিকায় টালমাটাল যাচ্ছে আরো বিভিন্ন দেশে। করোনা, কিট, টিকা, অ্যান্টিবডি টেস্টে যে যত সক্ষম, তার শিনা-ই বিশ্বে তত বেশি টান। যার যত টিকা বা ভ্যাকসিনের ঠিকাদারি-খবরদারি, সেই তত শক্তিমান। শক্তির এই জানান দেওয়ার দৌড় এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এ অঞ্চলে চীনের এ সক্ষমতা তুঙ্গে। চীনারা সঠিক সময়ে লকডাউন, মেডিসিন, নার্সিং, সার্ভিসিং এবং ভ্যাকসিন দিয়ে করোনা বিদায় করেছে। ভারত সেখানে হোঁচট খেয়েছে চরম আঘাতে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
মন্তব্য করুন