চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তথা সিপিসির প্রতিষ্ঠার শততম বর্ষ পূর্ণ হয়েছে ৩০ জুন। ১ জুলাই ছিল এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
এই শুভক্ষণে লাল সালাম জানাই সেইসব লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী শহীদদেরকে যারা জীবনের বিনিময়ে রক্তের আখরে লিখে গেছে এক মহাকাব্য, যার নাম গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। শুভেচ্ছা জানাই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সকল নেতৃবৃন্দ, পার্টির সকল পরীক্ষিত সদস্যবৃন্দ, শ্রমিক শ্রেণি, তার সহযোগী কৃষকসমাজ ও দেশপ্রেমিক পুঁজিপতি শ্রেণি এবং সর্বোপরি চীনের একশত চল্লিশ কোটি জনগণকে যারা প্রত্যেকে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সদাতৎপর থেকে হাজারো বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রাম জারি রেখে চীনকে পরিণত করেছে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে।
বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হযে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও যাত্রা শুরু হয়, ঠিক তখনই বিশালাকার চীনের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রিয়াশীল গ্রুপগুলো থেকে ৫২ জন কমিউনিস্টের মাত্র ১২ জন প্রতিনিধি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না, সিপিসি। প্রতিষ্ঠা লগ্নেই পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে তার মতাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে লেনিনীয় একশিলা পার্টি গঠনের পদ্ধতির অনুসরণে গণতান্ত্রিক নীতিমালার ভিত্তিতে আন্তঃপার্টি বিতর্কের মাধ্যমে চীনের নিজস্ব বাস্তবতা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের চীনদেশীয় প্রেক্ষাপটে তাকে মাওসেতুং থট, দেং শিয়াও পিংয়ের থিয়োরিতে বিকশিত করে আজ পৃথিবীর বৃহত্তম সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর এখানেই শেষ নয়, চলমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের রণকৌশল বিনির্মাণে আজ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে নবতর উচ্চতায় উন্নীত করেছেন যা একুশ শতকের মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ বলে স্বীকৃত।
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ মানবজাতির ইতিহাসের বিশ্বজনীন নিয়মাবলীকে তুলে ধরে প্রমাণ করেছে যে পুঁজিবাদী সমাজের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব অন্তর্গতভাবে সমাধানের অযোগ্য আর তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই সমাজে অনিবার্য একমাত্র সমাধান যা পর্যায়ক্রমে সমাজকে সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমে উন্নীত করবে। । প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তত্ত্বকে প্রয়োগ করে চীনের বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার সম্পন্ন করে সিপিসি গ্রহণ করে দলের রণনীতি, রণকৌশল এবং আশু ও চূড়ান্ত কর্মসূচি। আশু কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদের অবশেষ এবং বৈদেশিক আগ্রাসী শক্তি জাপ-সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে চীনের জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী কুয়োমিনটাঙ-এর সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে শুরু করে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম।
সিপিসি’র নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় সিপিসি’র সাথে ঐক্যবদ্ধ কুয়োমিন্টাঙের একটি প্রতিক্রিয়াশীল অংশ যার নেতৃত্বে ছিলো চিয়াং কাইশেক। চিয়াং কাইশেক আবার বেছে নেয় জাপ সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগিতার পথ। তাতে সিপিসিকে লাগাতার এক সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখতে হয়। সেই সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য জনগণকে সংগঠিত করে গড়ে তোলা পিপলস লিবারেশন আর্মি বা রেড আর্মির ধারণা ও নতুন ধরণের যুদ্ধ কৌশল প্রদান করার মাধ্যমে কমরেড মাও সে তুং যে অবদান রাখেন তা একেবারেই চীনা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাই মাও সে তুং-য়ের চিন্তাধারাও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের প্রয়োগিক সম্প্রসারণ বলে আজ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকৃত। কমরেড মাও সে তুং মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব অনুসরণ করে চীনের বাস্তবতায় একটি আধা সামন্তান্ত্রিক-আধা উপনিবেশিক দেশে প্রলেতারীয় পার্টি গঠনের এক অনন্য কৌশল গ্রহণ করেন যার নেতৃত্বে ছিলো শ্রমিক শ্রেণী এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় ছিলো কৃষক সমাজ ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী।
পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাও সে তুং-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলো হলো প্রথমত তিনি এমন একটি সংগঠন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যেটি আন্তরিকভাবে জনগণকে সেবা করবে এবং দ্বিতীয়ত যে সংগঠনটির থাকবে দৃঢ় মতাদর্শিক ভিত্তি। চীনা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন ধরণের এই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সফল লং মার্চের মাধ্যমে গড়ে তোলা ঘাঁটিসমূহে পার্টির শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে একদিকে চলমান থাকে দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন গৃহযুদ্ধ আর অপরদিকে চলমান থাকে জাপ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধ। এই দ্বিমুখী যুদ্ধকে যুগপৎভাবে মোকাবেলা করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি জয়যুক্ত হয়ে ১৯৪৯ সালে প্রলেতারীয় শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে প্রতিষ্ঠা করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। এরপর চলতে থাকে নব উদ্যমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ ও বিনির্মাণের পথে অগ্রযাত্রা। সেই পথ মোটেও সরল ও সহজ ছিলো না। কারণ তখনও পার্টিকে চালাতে হয়েছে ডান সুবিধাবাদ ও বাম হঠকারিতার বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তার শক্তিশালী মতাদর্শিক ভিত্তির কারণে কখনও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ থেকে বিচ্যুত হয়নি।
১৯৭৬ সালে কমরেড মাও সে তুং-এর মৃত্যুর পর চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে আসে নবতর উপলব্ধি। ১৯৭৮ সালে পার্টির নেতা দেং শিয়াও পিং-এর নেতৃত্বে অতীতের সকল কর্মকাণ্ডকে পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। সিপিসির একাদশতম কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় প্ল্যানারি সভায় প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে সকল ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা হয়। পার্টির অতীতে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনাপ্রবাহ থেকে সত্যকে উদঘাটন করে পার্টির সময়োপযোগী কর্মপন্থা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যে, দেশের অর্থনৈতিক গতি বেগবান করার লক্ষ্যে অনুসৃত কর্মসূচি সংস্কার করে তা বহির্বিশ্বের কাছে উন্মোচিত করে দিতে হবে। এখান থেকে সূচনা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অগ্রগতির নতুন যুগের। তারা ধাপে ধাপে নতুন নীতি কৌশল ও কর্মসূচি গ্রহণ ও অনুসরণ করতে শুরু করে যা চীনে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ ও আধুনিকায়নের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এভাবেই উদ্ভব ঘটে দেং শিয়াও পিং-এর থিয়োরি।
এ কথা অনস্বীকার্য যে এই নতুন ‘থিয়োরি’ও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের মৌল নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, যা আজকের দিনের চীনের জন্য প্রয়োগযোগ্য এবং মাও সে তুং-এর চিন্তাধারার ধারাবাহিকতা। তাই দেং শিয়াও পিং-এর পার্টি সংগঠন গড়ার কৌশলকে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্বের উল্লম্ফন বলে বিবেচনা করা হয়। যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নতুন যুগের উপযোগী কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে উঠবে অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে আধুনিক সমাজতন্ত্রের পথে সমগ্র দেশের জনগণকে পরিচালিত করার নেতৃত্ব প্রদান করার উপযোগী।
১৯৮৯ সালে সিপিসি’র ত্রয়োদশ কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ প্ল্যানারি সভায় সুচনা হয় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় প্রজন্ম যার মৌলবৈশিষ্ট্য হলো সমষ্টিগত নেতৃত্ব। কমরেড জিয়াং জেমিন এই নতুন ধরণের সংগঠনের কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে দেং শিয়াও পিং নির্ধারিত পথ অনুসরণ করে চীনা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের পথে অগ্রসর হতে থাকেন। যার লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে আরো বেগবান করে তোলা। এরপর থেকে চীনকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কারণ চীনের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা, জাতীয় প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও সংসক্তি অবিরাম ক্রমবর্ধমান হয়েছে। আর সিপিসি সবসময় চীনের উন্নয়নের ধারার অভিমুখে থেকে, চীনের উচ্চতর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব দিয়ে চীনের জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে। উপরন্তু জিয়ান জেমিন পার্টির ভিত্তিকে উচ্চতর অবস্থানে উন্নীত করার তত্ত্বকে ২০০২ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ষোড়শ জাতীয় কংগ্রেসে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাও সেতুংয়ের চিন্তাধারা-দেং শিয়াও পিংয়ের তত্ত্ব-শি জিনপিংয়ের চিন্তা এভাবেই পার্টির মতাদর্শিক লাইন ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ও তা সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করে আরো একধাপ অগ্রসর করার এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বশীল তত্ত্বকারদের মতাদর্শ ধারণ করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুসংবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য ও বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমে উত্তরণের লক্ষ্যে একটি পরিপক্ক সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ।
ইমেইল: bipi1963@gmail.com
মন্তব্য করুন