ঢাকা , বুধবার, ২০২৫ এপ্রিল ১৬, ২ বৈশাখ ১৪৩২
#

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

কর্ণফুলীতে ভুয়া অভিযোগে ‘ফুটবল রহিম’কে ফাঁসানোর চেষ্টা? অনুসন্ধানে উল্টো চিত্র

মুহাম্মদ ওসমান হোসেইন, কর্ণফুলী প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম।
প্রকাশিত : শনিবার, ২০২৫ এপ্রিল ১২, ০৫:৪০ অপরাহ্ন
#

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা এলাকার ক্রীড়া সংগঠক এম এ রহিম ওরফে ‘ফুটবল রহিম’-এর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও দেহ ব্যবসায় জড়িত সংক্রান্ত একটি অভিযোগপত্র সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে জমা দেওয়া হয়।

অভিযোগে বলা হয়, রহিম কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের কিছু কর্মকর্তাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে আসছেন। এসব সুবিধার আড়ালে তিনি লুটপাটে জড়িয়ে পড়েছেন বলেও দাবি করা হয়।

অভিযোগটি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর বিষয়টি আমলে নেয়। সত্যতা যাচাইয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশকে (সিএমপি)। বর্তমানে বিষয়টি অনুসন্ধান করছেন কর্ণফুলী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার জামাল উদ্দিন চৌধুরী।

সংবেদনশীল অভিযোগ পেয়ে কর্ণফুলীর কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী নিজ উদ্যোগে তদন্তে নামেন। কিন্তু শুরুতেই তারা অভিযোগপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

অভিযোগে যিনি বাদী হিসেবে নাম উল্লেখ করেছেন— রিয়াজুল হাসান অনিক, সহ-সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরিষদ, কর্ণফুলী উপজেলা শাখা— তাঁর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব মেলেনি। এমনকি উক্ত সংগঠনের কোনো স্থানীয় বা কেন্দ্রীয় কমিটিতে এমন নামের কাউকে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগপত্রে মোবাইল নম্বর বা কোনো যোগাযোগ মাধ্যমও নেই। এতে অভিযোগ যাচাই করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মনগড়া অভিযোগ কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।

এম এ রহিম সম্পর্কে জানা গেছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকার ক্রীড়াঙ্গনে সক্রিয়। তাঁর সহযোগিতায় অনেক ক্ষুদে ফুটবলার বিভিন্ন ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়েছে। এলাকাবাসীর মতে, তাঁর বিরুদ্ধে অতীতে এমন কোনো অভিযোগ ছিল না।

তবে অভিযোগপত্রে দাবি করা হয়, রহিম কালারপোল ক্রীড়া সংস্থার সভাপতির পদ জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করেন। এরপর সংগঠনের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন।

এছাড়া অভিযোগে বলা হয়, তিনি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় ক্রীড়া সম্পাদকের পদও দখলে নেন। ক্ষুদে ফুটবল প্রশিক্ষণের নামে সরকারি-বেসরকারি অনুদান আত্মসাৎ করেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, কর্ণফুলীর সাবেক ইউএনও শাহিনা সোলতানার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তাকে ব্যবহার করে উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার অনুদানের টাকা আত্মসাৎ করেন। একইভাবে কালারপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতির পদও দখল করেন।

অভিযোগে দাবি করা হয়, সভাপতি হওয়ার পর রহিমের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি শহিদুল ইসলাম রনি ওরফে 'পাইপ ফিটার রনি’র কাছে স্কুলের চাবি রাখা হতো। রাতে বিদ্যালয়ে অনৈতিক কাজ হতো বলেও অভিযোগে লেখা আছে।

এছাড়া রহিম উন্নয়নের নামে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা নিজের কাজে ব্যবহার করেছেন বলেও অভিযোগে দাবি করা হয়। কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে তিনি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বলেও লেখা হয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়া তাকে সহযোগিতা করেছেন। মামুন মিয়ার সুপারিশে তিনি থানার ওসি এবং প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছেন।

এমনকি মামুন মিয়ার ভাই জহির উদ্দিন বাবরকে কালারপোল ক্রীড়া একাডেমির চেয়ারম্যান করা হয়েছে। পুরো কমিটি সাজানো হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের দিয়ে, যাতে রহিম লাভবান হন।

এই সব অভিযোগ যাচাই করতে গত ১৫ দিন ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছেন প্রতিবেদক। তবে কোথাও অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। মিল-কারখানা থেকে চাঁদা আদায়ের কথাও কেউ নিশ্চিত করেননি। অভিযোগে কোথা থেকে কীভাবে চাঁদা তোলা হয়েছে, তাও স্পষ্ট নয়।

এ বিষয়ে কালারপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিরিন আক্তার বলেন, 'রহিম একজন ভালো মানুষ। তিনি স্কুলে ফ্যান, টেবিলসহ অনেক কিছু দিয়েছেন। স্কুলের সব কাজে সহযোগিতা করেন। চাবি দপ্তরী আর আমার কাছেই থাকে। অভিযোগগুলো মিথ্যা।'

একই কথা বলেন অভিভাবক প্রতিনিধি নাসিমা আক্তার। তাঁর ভাষায়, 'রহিম ভাই ভালো মানুষ। এমন কাজে জড়াতে পারেন না। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন।'

এই বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়ার সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

অভিযুক্ত এম এ রহিম বলেন, '৩ আগস্ট আমি এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ছিলাম। ভিডিও ফুটেজ ও পত্রিকায় তার প্রমাণ আছে। অথচ অভিযোগে বলা হয়েছে, আমি ওইদিন নিউ মার্কেট এলাকায় ছিলাম। এসব মিথ্যা অভিযোগ। কে বা কারা এগুলো করেছে জানি না।'

কালারপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শিকলবাহা ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার ইউপি সদস্য মোঃ আলমগীর বলেন, 'রহিম ভাই একজন ভালো মানুষ, পাশাপাশি একজন ক্রীড়াবিদ মানুষ। উনার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ কখনো বিশ্বাসযোগ্য নয়।'

কর্ণফুলী থানার ওসি মোহাম্মদ শরীফ বলেন, 'আমি এখানে নতুন। অভিযোগকারীর নামে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, এমন কেউ নেই। এটি একটি ভুয়া অভিযোগ।'

উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দা আমাতুল্লাহ আরজু বলেন, 'রহিম রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে স্কুলে আসেননি। এই স্কুলে উনার অবদান অনেক। স্কুলের জন্য যখন যা প্রয়োজন সব সময় সহযোগিতা পেয়েছি। ওনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট।'

জানতে চাইলে কর্ণফুলী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আমরা অনুসন্ধান করছি, তা সঠিক। তবে আমি এখন মিটিংয়ে, পরে কথা হবে।'

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

আরও খবর

Video