বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই নোভার (ছদ্মনাম) সঙ্গে প্রেম করছেন সুজন (ছদ্মনাম)। তাঁদের বোঝাপড়াও ভালো। একটাই মুশকিল, কোনো দায়িত্বই নিতে চান না সুজন। যেকোনো দায়িত্ব এলেই তিনি পালাই পালাই করেন। এখন সুজন ভালো চাকরি করছেন কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ এলেই তিনি ভীত হয়ে পড়েন, এত এত দায়িত্ব আমি কী করে পালন করবেন। তিনি ঘাবড়ে যান। এমন না যে তিনি নোভাকে ভালোবাসেন না বা তার সঙ্গে প্রতারণা করতে চান। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে তিনি কোনো দায়িত্বই নিতে চান না, তাঁর মধ্যে আছে কমিনমেন্ট ফোবিয়া। শুধু বিয়ের মতো বড় বিষয়ই নয়, দুজনে কিছু কেনাকাটা করার সময়ও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান সুজন; সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বটুকুও তিনি নিতে চান না। তাই চান বা না চান, নোভাকেই নিতে হয় সব দায়িত্ব।
সুজনের মতো এমন অনেকেই আছেন। কেবল সম্পর্ক বা প্রেম–ভালোবাসার ক্ষেত্রেই নয়; সংসারের যেকোনো দায়িত্ব, কর্মক্ষেত্রের রুটিন কাজের বাইরে বাড়তি কিছু দায়িত্ব বা সমাজে চলতে–ফিরতে কোনো দায়িত্ব নিতে তাঁরা ভয় পান। প্রেম বা দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে থাকলে সম্পর্কের জায়গাটি দুর্বল হতে থাকে। পারস্পরিক সম্পর্ককে মজবুত রাখতে দুজনকেই তাই দায়িত্ব নিতে হবে।
কেন এত ভয়
সামাজিক দক্ষতার অভাব: ছোটবেলা থেকে যদি কেউ সিদ্ধান্ত নিতে না শেখেন বা নিজের ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করার চর্চা না করেন, তখন তাঁর সামাজিক দক্ষতা কমে যায়। পরিণত বয়সে এসে তিনি কোনো দায়িত্ব নিতে ভয় পান। নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না।
সামাজিক উদ্বেগ: ‘যদি কোনো ভুল হয়ে যায়’, ‘যদি ঠিকঠাক কাজটি করতে না পারি’—এ ধরনের উদ্বেগে ভোগেন অনেকে। ভাবেন হয়তো কাজটি ঠিকঠাক করতে না পারলে লোকজন তাঁকে তুচ্ছজ্ঞান করবে। সেই ভয় থেকেও দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন তাঁরা।
সিদ্ধান্ত ঠিক আছে তো? ছবি: কবির হোসেন
মনের ওপর আঘাত: শৈশবে কেউ যদি শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তখন তাঁর মধ্যে একধরনের আবেগজনিত পরিবর্তন ঘটে। যেকোনো বিষয়কে তখন মানসিক কষ্টের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন তিনি। তিনি নিজেও আর আঘাত পেতে চান না, আবার তাঁর সিদ্ধান্তের কারণে কাছের মানুষটি দুঃখ পেতে পারেন ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত বা দায়িত্ব নেন না।
নিখুঁত হতে চাওয়া: কারও কারও মধ্যে আবার নিখুঁত হতে চাওয়ার একটা অবসেশন কাজ করে। সব কাজই তিনি নিখুঁত করতে চান। আর যদি নিখুঁত না হয় এই ভয়ে অনেক দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন।
যেভাবে দায়িত্ববান হবেন
হুট করে কারও মধ্যে দায়িত্বশীলতা আসে না। এটি চর্চার বিষয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সম্পর্কের ইস্যুতে দায়িত্ব না নিলে সম্পর্ক ফিকে হয়ে আসতে পারে। তাই প্রেম, ভালোবাসা ও দাম্পত্যে সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষকেই দায়িত্ব নেওয়ার চর্চা করতে হবে। এ জন্য যা যা করা যায়—
দূর করুন কমিউনিকেশন গ্যাপ: সম্পর্কের ভেতরে যেন কোনো আড়াল না থাকে। স্বচ্ছতা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাবলীল থাকতে হবে। পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ যত ভালো থাকবে, তত দায়িত্ববোধ বাড়বে। পরস্পরকে দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
প্রেম ও দাম্পত্যে সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষকেই দায়িত্ব নেওয়ার চর্চা করতে হবে। ছবিটি প্রতীকী ছবি: কবির হোসেন
সব সময় নিজের ঘাড়ে দায় নেবেন না: যা–ই ঘটুক না কেন, দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের অবস্থান প্রকাশ করুন। সব সময় সবকিছুর দায় নিজের ঘাড়ে নিতে থাকলে আত্মবিশ্বাস কমতে থাকবে। ‘যা–ই ঘটুক না কেন, দায় তো আমার’ ধরনের মনোভাব একপর্যায়ে আপনাকে প্রকৃত দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে বাধ্য করবে।
নিজেকে ধন্যবাদ দিন: প্রতিদিন একবার করে নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন, নিজের মনের যত্ন নিন, নিজেকে ধন্যবাদ দিন। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। দায়িত্ব নেওয়া সহজ হবে।
সঙ্গীর অনুভূতি বুঝুন: আপনার যিনি পার্টনার তাঁর অনুভূতিগুলো বোঝা খুব প্রয়োজন। তিনি যখন চাচ্ছেন আপনিই দায়িত্ব নিন, তখনো আপনি যদি দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন, তাহলে তিনি আপনার ওপর আস্থা হারাবেন। দায়িত্ব নেওয়াকে পরাজয় মনে করবেন না।
ভুলকে মেনে নিতে শিখুন: ভুল হতেই পারে। নিজের ভুলটুকু স্বীকার করে নিন। ভুল স্বীকার করার অর্থই হচ্ছে সেটার সিংহভাগ সংশোধিত হয়ে যাওয়া। ভুল বুঝতে পারা, আর তা স্বীকার করাও একধরনের দায়িত্ববোধ। তাই ভুল স্বীকার করার মধ্য দিয়ে দায়িত্ববোধের চর্চা করুন। অপর দিকে আপনার সঙ্গী ভুল স্বীকার করে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিলে আপনিও সেটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আপনার দায়িত্বও পালন করুন।
তবে একটা কথা মনে রাখবেন, প্রেম–ভালোবাসায় দায়িত্ব নেওয়াটাই কিন্তু সব না। অন্তরঙ্গতা, আবেগ আর বিশ্বস্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল কেজো দায়িত্বের ভারে প্রেম–ভালোবাসার রোমান্টিকতা যেন উবে না যায়, সেদিকেও মনোযোগী হতে হবে।
মন্তব্য করুন