বাক-স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর দশটা গণতান্ত্রিক অধিকারের মতো নয়, এটি গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি। এটি গণতন্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান। তাই এই অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া, সংরক্ষণ করা ও তাকে বিকশিত করা রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এছাড়াও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেশের আইন দ্বারা এবং জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক বলবৎযোগ্য। রাষ্ট্র এটা রক্ষায় ব্যর্থ হলে বুঝে নিতে হয়, সে নিজের প্রধান কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাক-স্বাধীনতা মানুষের সভ্যতার নিদর্শন। ভাষা আছে বাক-স্বাধীনতা নেই, সেই ভাষা মূল্যহীন। গণতন্ত্র আছে, বাক-স্বাধীনতা নেই, সেই গণতন্ত্র মৃত।
মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা যদি রক্ষিত না হয় তাহলে অশুভ শক্তির বিকাশ দৃশ্য-অদৃশ্য সব স্তরে ঘটে। ফলে সহনশীল সংস্কৃতির পরিবর্তে, অসহনশীল দানবীয় সংস্কৃতি জায়গা করে নেয়; যা রাষ্ট্র ও সমাজকে আক্রান্ত করে। এজন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল শর্ত পক্ষ-বিপক্ষের চিন্তার অধিকার রক্ষা করা।
বাক-স্বাধীনতার মধ্যে কথা বলা, কথা শোনার অধিকারও রয়েছে; তথ্য পাওয়া, চাওয়া, আলোচনা ও বিতর্ক করাও এর মধ্যে পড়ে। সে কারণে এটি সর্বজনীন অধিকার, শুধু একক ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশের অধিকার নয়। বাকস্বাধীনতা হল এমন একটি নীতি যা প্রতিশোধ, সেন্সরশিপ বা আইনি অনুমোদনের ভয় ছাড়াই একজন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের তাদের মতামত এবং ধারণা প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে।
জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত করা হয়েছে । বাংলাদেশসহ অনেক দেশে সাংবিধানিক আইন আছে যা বাকস্বাধীনতা রক্ষা করে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, 'প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। অবাধে মতামত পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যে কোন মাধ্যমের মারফত ভাব এবং তথ্য জ্ঞাপন, গ্রহণ ও সন্ধানের স্বাধীনতাও এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।' এরপরও অনেক দেশে বাক স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে।
বাকস্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় স্বৈরশাসক ও একনায়কতন্ত্র শাসকরা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যই মূলত বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়। বাকস্বাধীনতা থাকলে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন দু'দিন আগে হোক বা দু'দিন পরেই হোক ঘটতে বাধ্য। এতে তাদের স্বৈরশাসন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে । বাকস্বাধীনতা দুর্নীতিবাজ, লুটেরা গোষ্ঠীসহ অশুভ শক্তির পছন্দের নয়। কারণ বলার অধিকার ও লিখার অধিকার না থাকলে অপকর্মগুলো করা সহজ হয়।
বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে চরম সঙ্কটে আছে বাক-স্বাধীনতা নিয়ে। বাক-স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায় মানুষকে এখন খুবই ভেবেচিন্তে কথা বলতে হচ্ছে। পরিস্থিতির কারণে মানুষ নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে। কিছু লিখলে বা কোনো কথা বললে সরকারের বিরুদ্ধে যায় কিনা, বক্তব্য কোনোভাবে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যায় কিনা, সরকার দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে যায় কিনা, সরকারি দলের নেতার বিরুদ্ধে যায় কিনা, সেই ভাবনা এখন বড় শঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
সমালোচনার সীমারেখা এমনভাবে টেনে দেয়া হয়েছে যে, কিছু রাজনীতিকের নাম মুখেও আনা যায়না। তাদের সমালোচনা মানেই চৌদ্দশিকের ভাত খেতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বাক-স্বাধীনতা। তাইতো নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন : 'বাক-স্বাধীনতা প্রকৃত পক্ষে মানব স্বাধীনতারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারা, অন্যের কথা (মতামত) শুনতে পারার সক্ষমতা; এটি হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমাদের মূল্যবান হওয়ার কেন্দ্রীয় কারণ ।' আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই উপলব্ধি আমাদের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়নি।
ভিন্নমতের বিরুদ্ধে সরকারের অসহিষ্ণু অবস্থান বাক-স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত করেছে। সরকারের নানান পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে এমন এক ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যেখানে অনেকেই মুক্তভাবে তাদের মনের কথা বলতে পারেনা । এ এক শ্বাসরোধী পরিস্থিতি।
লিখবেনই বা কী করে!
বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতার কতটা নাজুক অবস্থায় আছে তার চিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কলামিষ্ট প্রফেসর ড. আসিফ নজরুলের লেখায় ফুটে উঠেছে। তিনি 'কী কী লেখা যাবে না' শিরোনামের এক প্রবন্ধ লিখেছেন, 'একটা সময় ছিল, পত্রিকার কলাম লিখতে বসলে মন খুলে লিখতাম। যা লিখতাম তাই ছাপানোও হতো। আর এখন লেখার আগে ক্লান্তিময় লড়াই চলে নিজের ভেতর। কী লিখলে মামলা হতে পারে, কী লিখলে অপপ্রচার বা আরও নানা সমস্যা সেটা নিয়ে চিন্তা করে করে বিমর্ষ হই। না ছাপানো গেলে শুধু শুধু লিখে লাভ কী—এটা ভেবে থেমে থাকি মাঝেমধ্যে।'
তিনি প্রবন্ধ আরো পরিষ্কার করে বলেন, 'আমার ধারণা, অন্য অনেকেরও একই অবস্থা। যাঁদের লেখা আমি পাঁচ–সাত বছর আগেও অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়তাম, তাঁদের অনেকে বিবর্ণ ও পানসে হয়ে গেছেন তাই। আমাদের বাক্স্বাধীনতা শুধু নয়, চিন্তার চর্চাও সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে নানাভাবে। মনে মনে ঠিক করি কী লিখব, কী লিখতে পারি না। কী কী লিখতে পারি না তার তালিকা বিশাল। বিষয় হিসেবে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণও। রাখঢাক করে তার একটা তালিকা দিই।'
সংবাদমাধ্যম ও নাগরিকের মতপ্রকাশ করার ক্ষেত্র যতটা সংকুচিত করা সম্ভব, তার প্রায় পুরোটাই তারা করতে পেরেছে। এমন অবস্থায় কোনো একটি পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি যদি নিশঙ্কও হয়, সেটিও বাস্তবায়ন করা কঠিন।'
টিভি টকশোতে কেউ মন খুলে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না। যারা সাহস করে সত্য কথা বলেন, তাদের পরে আর টকশোতে ডাকা হয় না । শুধু নিপীড়ন চালিয়েই নয়, বিভিন্ন ধরণের কালা কানুন করে বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে ভয়ঙ্কর এক কালাকানুন করে মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়। এই আইনেনে সাংবাদিক ও ভিন্নমতের লোকজনের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। দুনিয়াজুড়ে এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে এই বাতিল করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে অন্য একটি আইন করে সরকার। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নের সব ধারা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এই আইনটিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সাংবাদিক ও ভিন্নমতের মানুষের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে সামনে আসে।
শুধু ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টই নয়, এ ধরণের অনেক গুলো আইন রয়েছে যে গুলোর মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা হরণ করা যায়। এরমধ্যে রয়েছে ১. পেনাল কোড ১৯৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি); ২. ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪); ৩. অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩; ৪. আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩; ৫. প্রিন্টিং প্রেস ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৩; ৬. প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; ৭. সংবাদপত্র কর্মচারী (পরিষেবার শর্ত) আইন, ১৯৭৪; ৮. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ৯. ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন, ২০২১; ১১. ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্ট বেজড সার্ভিস প্রভাইডিং অ্যান্ড অপারেশন পলিসি, ২০২১ (আইসিটি বিভাগ দ্বারা); এবং ১২. (খসড়া) ম্যাস মিডিয়া কর্মচারী (পরিষেবার শর্তাবলি) আইন ২০২২।
এই মুহূর্তে, নিপীড়নমূলক আরো তিনটি খসড়া আইন পাইপলাইনে রয়েছে- একটি তথ্য সুরক্ষা নিয়ে, দ্বিতীয়টি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং তৃতীয়টি মিডিয়া কর্মীদের পরিষেবার শর্তগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তথ্য সুরক্ষার জন্য যে খসড়া তৈরি করা হয়েছ,এর বিপজ্জনক অংশটি হলো এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এর ফলে তারা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সমস্ত অধিকার লঙ্ঘন করে, যে কোনো উপায়ে ব্যক্তিগত উপাত্ত স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারবে।
লেখকঃ কবি ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন