বিশেষ প্রতিবেদন : সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর। এই যেন এক নতুন সম্রাজ্য। কাজী মশিউর রহমান-গাজী সাদেক-গফুর মেম্বার এই তিনজনে রাজত্ব এখানে। সরকারি-বেসরকারি পাহাড় কেঁটে হাজার হাজার প্লট তৈরী, এক প্লট কয়েকজনের কাছে বিক্রি, জোরপূর্বক জায়গা দখল, খুন, ধর্ষণ, চাদাঁবাজি, হয়রানিসহ বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত তারা।
জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে ২৪টিভি'র ৪ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ১ম পর্ব-
জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি গাজী সাদেক,সাধারণ সম্পাদক কাজী মশিউর রহমান ও মামলা কারণে পদ হারা ইউপি সদস্য গফুর মেম্বার এরা তিন জন রাজনৈতিক প্রভাব ও সংগঠনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে এসব অপরাধ কর্মকান্ড নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে।
কে এই কাজী মশিউর রহমান?
১৯৯৬ সালে খুলনা থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে আসেন কাজী মশিউর রহমান। ফেরিওয়ালা হিসেবে কাজ শুরু করে। এর বছর দুয়েকের মধ্যে চট্টগ্রাম হকার সমিতির সভাপতিও হন। ২০০৩ সালে সীতাকুণ্ড জঙ্গিল সলিমপুরের ত্রাস আক্কাস আলীর হাত ধরে জঙ্গিল ছলিমপুর পাহাড়ি এলাকার ছিন্নমূলে অবস্থান নেন। কিছুদিন পর সন্ত্রাসী আক্কাস আলী বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়। পরে ছিন্নমূল বস্তিবাসী সংগ্রাম কমিটির সভাপতি রোকন উদ্দিনের সঙ্গে কাজ করতে থাকে মশিউর। এর ফাঁকে আওয়ামীলীগেরযোগ দেয় কাজী মশিউর রহমান। বর্তমানে সে সলিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বলে তিনি দাবি করেছেন। গড়ে তোলে তার সাম্রাজ্য। অল্প কয়েকদিনেই সরকারি পাহাড় দখল করে সেখানে প্লট বানিয়ে বিক্রি করে বনে যায় কোটিপতি।

কাজী মশিউর রহমান এর আলোচিত মামলাসমূহ
মশিউর ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অসংখ্য মামলা থেকে আলোচিত মামলার মধ্যে রয়েছে, ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট নগরীর বায়েজীদ বোস্তামী থানার আরেফীন নগর এলাকায় হকার বেলাল হোসেনকে নির্মমভাবে খুন। ২০১১ সালে হাজেরা বেগম (২৩) নামে এক নারীকে রাতভর গণধর্ষণ। ২০১২ সালে সুমি আক্তার (১৯) নামে এক অসহায় গার্মেন্টস কর্মীকে পাহাড়ে নিয়ে গণধর্ষণ ও অবর্ণনীয় নির্যাতন।
গত ২৫ অক্টোবর ২০১৭ সোমবার সীতাকুণ্ডের দুর্গম জঙ্গল সলিমপুর পাহাড়ে অভিযান চালায় র্যাব এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীসহ আটক করে জঙ্গলের অঘোষিত ‘সন্ত্রাসী রাজা’ কাজী মশিউরকে। এ সময় দেশি-বিদেশি কার্তুজ ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়।

বর্তমান চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন এলাকায় তার রয়েছে বিশাল বাড়ি। এছাড়াও জঙ্গল সলিমপুরেও রয়েছে কয়েকটি দালান বাড়ি। কিছুদিন আগে বিএনপি সমর্থিত রোকন উদ্দিনকে হটিয়ে জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদ দখলে নেন তিনি। জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে এসব অপরাধ কর্মকান্ড নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে মশিউর ও তার দলবল। পাহাড় বেচা টাকায় গত কয়েক বছরে দেশের নানা প্রান্তের সন্ত্রাসীদের অবায়শ্রম হিসেবে জঙ্গল সলিপুরকে গড়ে তুলেছে মশিউর। মশিউর চাঁদাবাজি মামলায় জেলে বন্দি থাকলেও এখন আবার বের হয়ে নিজের গড়া অপরাধ সম্রাজ্যের আধিপত্য গ্রহণ করেছে। বর্তমানে নিজের দুই বিশ্বস্ত সহযোগীকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে জঙ্গল সলিমপুর এলাকা। চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড ও নগরের বায়েজীদ থানার মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকার নাম জঙ্গল সলিমপুর। যাতায়াত ব্যবস্থা নাজুক হওয়ায় এ এলাকায় সাধারণ মানুষদের যাতায়াত কম। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গা ঢাকা দিতে মশিউর বাহিনীর শরণাপন্ন হয় সন্ত্রাসীরা। শেষতক নিজের দল ভারী করতে ওইসব সন্ত্রাসীদের ঠাঁয় দেয় সে। তাদের দিয়ে চলে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, জবরদখলসহ সব রকম অপরাধ।

সংশ্লিষ্ট আরো জানা যায়, জুলাই ২০১৭ প্রথম দিকে পুনর্গঠন করা হয় তাদের কমিটি। এতে সভাপতি হয় গাজী সাদেক ও সেক্রেটারি হয় মশিউর রহমান। আর এলাকা ছাড়তে হয় রোকন উদ্দিনকে। সাবেক সভাপতি রোকন উদ্দিন বলেন, ২০০৪ সালে পাহাড়ে বাগান এবং সমতলে বসবাস করব বলে সরকারের কাছে আবেদন করে বসবাস শুরু করি। তখন কোনো ধরনের পাহাড় কাটা হয়নি। ২০১০ সালের পরে মশিউরের নেতৃত্বে পাহাড় কাটা শুরু হয়। মশিউরের বিরুদ্ধে বায়েজিদ, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, খুলশীসহ বিভিন্ন থানায় ৩৫টি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে ৩ থেকে ৪টি হত্যা মামলা। তার অনুসারী ৩০ জন সন্ত্রাসী পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া তার সহযোগীদের রয়েছে একাধিক মামলা। তার সহযোগীদের মনির হোসেন ওরপে ভূমিদস্যু মনির, আলম প্রকাশ গালকাটা আলম, হাসান প্রকাশ জেনটার হাসান,আল আমিন সাগর প্রকাশ পিস্তল আল আমিন সাগর, মোস্তাফা করিম কাউচার প্রকাশ খুনি কাউচার, মিজান প্রকাশ চশমা মিজান, সাগর প্রকাশ পিচ্ছি সাগর সায়েম প্রকাশ বর্মা সায়েম সহ বেশ কয়েকজন।
খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি মামলায় তাদের ফাঁসানো হয়েছে দাবি করে চিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধ ৭টি ধর্ষণসহ ১৯টি মামলা রয়েছে, এগুলো সব মিথ্যা মামলা। একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আমাদের বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্যে এসব মামলা দায়ের করেছে। তিনি বলেন, এখানে যে পাহাড়গুলো কাটা হয়েছে তা ২০১০ সালের পূর্বে।

জঙ্গল সলিমপুর পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই সজীব হোসাইন জানান, দিনের বেলায় পাহাড় কাটা হয়না। রাতের আঁধারে কেউ না দেখে মতো পাহাড় কাটে একটা চক্র। ফোর্স কম থাকায় আমরা অভিযান চালাতে পারি না।

পুলিশ কে মাসিক মাসোহারা দে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আমি কাউকে কোন ভাবে পাহাড় কাটায় প্রশ্রয় দি না। মাসোহারা নেয়া প্রশ্নই আসে না। আপনার কাছে কোন প্রমাণ থাকলে দেন।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই জানান, তিন -পাঁচ হাজার টাকায় টোকেন পাহাড়ের সুযোগ করে দেয় পুলিশ।
একই সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত মাসোহারাও দে এই মশিউর-সাদের -গফুর বাহিনী।
এলাকাবাসী জানান, এই মাসোহারার জন্য তারা আইনকে অমান্য করে দিব্যি তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে ভয় পায় সাধারণ জনগণ।